শুক্লা

                                     

আমি তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। আমার স্কুলের নাম "লালগোলা শৈলজা মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল"। সদ্য গ্রামের প্রাইমারী স্কুল থেকে বৃত্তি পাশকরে হাই স্কুলে পাঁচক্লাসে ভর্তি হয়েছি।গ্রামের স্কুলে ছিলাম মুক্তবিহঙ্গী। কিন্তু এখানে অনেক অনুশাসন অনেক আদব কায়দা। সেসব তো কিছুই শিখিনি। তারউপর ছিল উড়নচন্ডী স্বভাব।ছিলাম বন্ধনহীন।এখানে অনুশাসনের গন্ডীতে আবদ্ধ। যে  দিদিরা শান্ত ছিলেন তাদেরক্লাস করতে ভাল লাগত। যাঁরা একটু কড়া স্বভাবের তাঁদের ক্লাস করতাম ঠিকই কিন্তু মাথায় কিছু ঢুকতো না। ফলে কান ধরে বাইরে দাঁড়ানো শাস্তি। এমনই একদিন শাস্তি ভোগ করছি হঠাৎ কানে এল রাজকন্যা এসেছে রাজকন্যা এসেছে। ফিসফাস গুঞ্জন। ইতিমধ্যে টিফিনের ঘন্টা পড়েছে প্রায় সবার মুখে একই কথা। লালগোলার রাজপরিবার তখনলালগোলার পাট চুকিয়ে কলকাতায় বাস করছেন। রাজবাড়ির এক অংশে আমাদের স্কুল। মনেমনে ভাবছি শৈলজাদেবীও তো রাজ কন্যা তবে কি তিনি? পরক্ষণেই ভাবি তা কি করে হয় উনি তো বেঁচে নেই। সব তালগোল পাকিয়ে যায়। আমার মাথায় তখন রূপকথার রাজকন্যার ছবি ভাসছে। অতএব যেমন করেই হোক রাজকন্যা দেখতেই হবে।

আমার দুই ক্ষুদে বন্ধু তখন ডাকছে শ্যামাদার মাখা চানাচুরের খঞ্চার কাছে। সেলোভও আছে। তাছাড়া আমার ইজারের পকেটে সেদিন চকচকেএকটি সিকি ছিল। সে আরেক ইতিহাস। আমার এক দাদু বেড়াতে এসেছিলেন। যাওয়ার সময় সব ভাইবোনের হাতে একটি করে সিকি অর্থাৎ( পঁচিশপয়সা) দিয়ে গিয়েছিলেন। আমার তো আনন্দ ধরে না সিকি মানে চারআনা মানে চারটে আইসক্রীম। কি সুন্দর গোলাপী হলুদ সাদা জমানো জল! অথচ ঠাম্মার কড়া নির্দেশের সেটা প্রকাশ্যে খেতে পারতাম না।ওতে নাকি বারো জাতের ছোঁওয়া জল আছে খেলেই জাত যাবে. এখন যদি বেঁচে থাকতেন আমার ঠাম্মামনি? যাই হোক চুরি করেই আইসক্রীম খেতাম নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার আনন্দে।

আমি সেদিন সেই সিকিটা ভাঙিয়ে একটা আইসক্রীম কিনে চুষতে চুষতে বড়দির অফিস ঘরের বারান্দায় হাজির। আমার মাথায় ঘুরছে রাজকন্যা।দেখতেই হবে। রাজকন্যা কেমন। মুখে আইসক্রীম নিয়ে বড়দির ঘরের পর্দাটা সরিয়ে যেই না উঁকি দিয়েছি মাননীয়া হেডমিস্ট্রেস শান্তা সেনের চোখে  চোখপড়েছে। ইশারায়  ভেতরে ডাকলেন। আমি গুটি পায়ে হাজির। মুখে আইসক্রীম। জলদগম্ভীর স্বরে বললেন কি চাই? আমি থতমত খেয়ে বললাম কিছু না তো! বড়দি বোধহয় কোন গুরুত্বপূর্ণ পেপার দেখছিলেন। চোখ না তুলেই বললেন কানেধরে দাঁড়িয়ে থাক।

কান ধরতে গেলে আইসক্রীম ছাড়তে হয়। অতএব আইসক্রীমকে পকেটে চালান করে দিয়ে কান ধরে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে আমার চোখ গিয়েছেপরম অভীষ্টের দিকে "রাজকন্যা"। এতদিন পরেও সে রূপ আমার চোখ জুড়ে আছে। তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা, একরাশ কালো কুঞ্চিত কেশদাম,আয়ত দুটি চক্ষু, পক্কবিম্বাধরের মতো পাতলা দুটিওষ্ঠ। কাঁচাহলুদ রঙের সিল্কের শাড়িতে মনে হচ্ছিল মা সরস্বতী যেন স্বয়ং নেমে এসেছেন বিদ্যায়তনে। আমার মন ওচোখ খুশিতে ও প্রাপ্তিতে ভরে গিয়েছিল।

প্রায় মিনিট পনের অতিক্রান্ত। আমার আইসক্রীম তখন রঙিন জল হয়ে রাজকন্যা ও বড়দির পায়ের তলায় গিয়ে ঠেকেছে। চকিতে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বড়দি আমার দিকে তাকিয়েছেন রাজকন্যাও। ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছো কেন শান্তা দি? আহা রে তোর আইসক্রীমটা যে গলে গেল!  বীণা বিনিন্দিত কন্ঠে রাজকন্যা বললেন। বড়দি বললেল কি দেখছিলি অমন করে?

আমি তোতলিয়ে বললাম রা-জ-ক-ন্যা

খিলখিল করে হেসে উঠলেন উনি বড়দির ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি। বড়দি বললেন যা ক্লাসে যা আর কোনদিন পর্দা সরিয়ে দেখবি না। রাজ্য জয় করার আনন্দ নিয়ে বেড়িয়ে এলাম দুদিন পর রাজকুমারী স্কুলের সকলকে দুধমালাই আইসক্রীম খাইয়ে ছিলেন কিন্তু আমি সেদিন স্কুলে যাইনি। আমার মেয়ে যখন ক্লাস টেন তখনও বড়দি স্কুলে ছিলেন এবং আমার মেয়েরক্লাসে গল্পচ্ছলে ঘটনাটা বলেছিলেন। বড়দি ততদিনে আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছেন।


পরিচিতি
Previous Post Next Post

বিজ্ঞাপন